আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
الترغيب والترهيب للمنذري
ইসলাম শান্তি, সহমর্মিতা, পরোপকার ও মানবতার জীবন-দর্শন। পবিত্র কুরআনের ভাষ্যমতে ইসলামের বাস্তবরূপ হযরত রাসূলে আকরাম ﷺ-এর মাঝে বিদ্যমান। এ কারণেই কুরআনে কারীমে তাঁর বিষয়ে বলা হয়েছে 'উসওয়াতুন হাসানা' বা অনুপম জীবনাদর্শ। এই জীবনাদর্শের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বিপুল সংখ্যক হাদীসের মাঝে। যার কারণে যুগে যুগে আমাদের উলামায়ে কিরাম হাদীসের উপর ব্যাপক সাধনা করেছেন। প্রিয়তম রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর শাশ্বত বাণীকে মানুষের নিকট উপস্থাপনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এ গ্রন্থখানি সে অনবদ্য শ্রমের অন্যতম ফসল।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেনঃ "তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ায় পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমা লঙ্ঘনে একে অন্যের সাহায্য করো না।" (আল-কুরআন ৫:২)
মুমিনমাত্রেরই উচিত সৎকর্ম ও তাকওয়ার কাজে একে অপরকে সাহায্য করা। আর একইসঙ্গে পাপ ও সীমা লঙ্ঘনের কাজে সাহায্য না করা এবং সাধ্যমত বাধা প্রদান করা। ইসলামের ফরয ইবাদত, হালাল উপার্জন, পারস্পরিক সম্পর্ক, যিকির-আযকার, প্রভৃতি কাজের কল্যাণমূলক দিকগুলোর প্রতি উৎসাহ দান, এর ফযীলত ও সাওয়াবের বিষয়ে রাসূলে করীম ﷺ-এর অসংখ্য হাদীস রয়েছে সিহাহ সিত্তাহসহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে। ঠিক একইভাবে অন্যায়-অসৎ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমকে নিরুৎসাহিত করে এসব কাজের জন্য শাস্তির ভীতি প্রদর্শনমূলক অনেক বাণীও রয়েছে হাদীস গ্রন্থসমূহে।
'সৎকাজের প্রতি উৎসাহ দান, এর পুরস্কার এবং অন্যায় ও অসৎকাজ থেকে বিরত থাকার জন্য ভীতি প্রদর্শন ও এর শাস্তি' সংক্রান্ত হাদীসে রাসূল ﷺ-সমূহ একত্রিত করে ইমাম হাফিয যাকীউদ্দীন আল-মুনযিরী (রা) 'আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব' (চারখণ্ডে সমাপ্ত) নামে এ বিরাট গ্রন্থটি সংকলন করেন। সারা বিশ্বের মুসলিম পণ্ডিত ও ইসলামী ব্যক্তিত্বের নিকট আল্লামা মুনযিরী ও তাঁর গ্রন্থ সুপরিচিত ও ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
হাফিয মুনযিরী (র)
[৫৮১ হি.- ৬৫৬ হি.।
আল্লামা আবদুল আযীম ইবনে আবদুল কাবী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সালামা ইবনে সা'দ ছিলেন একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও হাফিয-ই-হাদীস। শায়খুল ইসলাম যাকীউদ্দীন আবু মুহাম্মদ মুনযিরী শামী অতঃপর মিসরী ছিলেন একজন উঁচু মাপের ওলী ও হাদীসের ইমাম।
তিনি শরীআতের একজন প্রতিষ্ঠিত হুজ্জত ছিলেন। তিনি তাঁর সমগ্র জীবন ইলম অর্জন ও ইলম শিক্ষাদানে ব্যয় করেন। তিনি রাসুলুল্লাহ্ ﷺ-এর হাদীস ব্যাখ্যা করেন এবং হাদীস রিওয়ায়াত করেন। তিনি হাদীসের সহীহ, হাসান, মুরসাল ও যঈফ বিষয়ক বর্ণনা দান করেন। তিনি হাদীস রিওয়ায়াতকারীদের অবস্থা বর্ণনা করে বিশ্ববাসীর উপকার সাধন করেন। যেহেতু তিনি আল্লাহ্-ভীরু ছিলেন, তাই তাঁর ইলম ফলদায়ক হয়েছে এবং তাঁর নিষ্ঠার কারণে তাঁর শিক্ষা উম্মতকে উপকৃত করেছে। তিনি আল্লাহর পথে জিহাদের পূর্ণ হক আদায় করেছেন। কাজেই তাঁর শিষ্যবর্গের মধ্যে আল্লাহ্ প্রভূত কল্যাণ ও বরকত দান করেছেন। তিনি আমাদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং উপযুক্ত নেতা ছিলেন। তাঁর দু'আ কবুল হতো। তাঁর সমকালে তাঁকে বরকতময় মনে করা হতো এবং ফাতওয়ার ব্যাপারে লোকেরা তাঁর শরণাপন্ন হতো। তিনি ছিলেন লোকদের জন্য উজ্জ্বল নিয়ামত, জ্যোতির্ময় অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, নিগূঢ় তথ্য উদ্ঘাটক এবং দুর্বোধ্য অর্থ ব্যাখ্যাদানে অমূল্য রত্ন স্বরূপ।
তাজুদ্দীন সুবকী (র) তাঁর 'তাবাকাত' গ্রন্থে হাফিয মুনযিরী সম্পর্কে বলেন, আমরা তাঁর আলোচনার দ্বারা আল্লাহর রহমত কামনা করতাম। তাঁর ইলমের বদৌলতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অবতীর্ণ হবে বলে আশা করা হতো। তিনি আল্লাহ্-ভীতি, পরহেযগারী এবং ফিক্হশাস্ত্রের পূর্ণ জ্ঞান-ভাণ্ডার অপরিমিতভাবে লাভ করেন। হাদীসশাস্ত্রে একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, তিনি যুগের শ্রেষ্ঠ হাফিযে হাদীস ও প্রাজ্ঞ আলিম ছিলেন। যঈফ ও সহীহ হাদীসের মধ্যে পার্থক্যকরণে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। রিজালশাস্ত্র ছিল তাঁর নখদর্পণে। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাসম্পন্ন। আহকামে সুন্নাহ, দুর্বোধ্য হাদীসের অর্থ উদ্ধার, শব্দমালার স্বরচিহ্ন চিহ্নিতকরণ, ইমামদের মতভেদ ইত্যাকার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অপরিসীম পাণ্ডিত্যের অধিকারী।
জন্ম ও তাঁর উস্তাদবর্গ
৫৮১ হিজরী সনের শাবান মাসের ১ তারিখে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমাম আবুল কাসিম আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ আল-কারশী আল-ওয়াররাকের নিকট ফিকহশাস্ত্রে গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি আবূ আবদুল্লাহ আরায়িহী ও আবদুল মুজিব ইবনে যুহায়র, মুহাম্মদ ইবনে সাঈদ মাসুনী, মুতাহহার ইবনে আবু বাকর বায়হাকী, হাফিয রবীউল ইয়ামান এবং প্রসিদ্ধ হাফিয আলী ইবনে ফাযল মাকদিসী প্রমুখ হতে হাদীস বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করেন এবং তাঁদের নিকট থেকে হাদীসের সনদ লাভ করেন। তিনি ৬৫৬ হিজরীর ৪ঠা যিলকদ মাসে ইন্তিকাল করেন।
ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর
তিনি তাঁর দেশ থেকে মক্কাভিমুখে চলে যান। সেখানে তিনি আবু আবদুল্লাহ ইবনুল বান্না ও তাঁর সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণের নিকট হাদীস শিক্ষালাভ করেন। অতঃপর তিনি দামেশক্ চলে যান এবং সেখানে উমর ইবনে তাবারজাদ, মুহাম্মদ ইবনে ওয়াহব ইবনে শরীফ, খায়র ইবনে কামিল, আবুল ইয়ামান আল-কিন্দী এবং অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শোনেন। অতঃপর তিনি বাহরায়ন, রিহা, আলেকজান্দ্রিয়া ও অন্যান্য শহরের মুহাদ্দিসগণের নিকট হাদীস বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।
রচনাবলী
তিনি ফিকহশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান অর্জনের পর 'তানবীহ' নামক কিতাবের একখানা ব্যাখ্যা গ্রন্থ লেখেন। তিনি সুনানে আবু দাউদ থেকে বাছাই করে 'মুখতাসার' নামে একখানা কিতাব সঙ্কলন করেন এবং এতে টীকা সংযোজন করেন যা পাঠকদের জন্যে একখানা উপকারী গ্রন্থ। এতদ্ব্যতীত সহীহ মুসলিম থেকে চয়ণকৃত তাঁর একটি মুখতাসার গ্রন্থ রয়েছে। তিনি একখানা বিশাল মু'জাম জাতীয় হাদীস গ্রন্থ নিজের জন্য রচনা করেন যা বিদ্যানুরাগীদের জন্য অত্যন্ত উপাদেয়। তিনি অনেক মাসআলার ব্যাপারে ফাতওয়া প্রদান করেন। এতদ্ব্যতীত তিনি অনেক হাদীসের উৎস নির্ণয় করেছেন। তাঁর ইলম দ্বারা জগদ্বাসী উপকৃত হয়েছে। তাঁরই বরাতে হাফিয আবু মুহাম্মদ দিময়াতী এবং মুতাআখখিরীন আলিম সমাজের ইমাম তাকিউদ্দিন ইবনে দাকিকুল ঈদ, শরীফ ইযযুদ্দীন ও অপরাপর আলিমগণ হাদীসের উৎস নির্ণয় করেছেন। তাঁর জ্ঞান-গরিমা তাদেরকে উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। আমি বালবিস শহরের অনেককে বলতে শুনেছি যে, আবু তাহির ইসমাঈল ইবনে আহমদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে আলী ইবনে সায়ফ তাঁর নিকট হাদীসের সনদ লাভ করেন। ইমাম যাহবী (র) বলেন, তাঁর সমসাময়িককালে তাঁর চেয়ে অধিক হাদীস মুখস্থকারী কেউ ছিলেন না। তাঁর কবিতার একটি অংশ এইঃ
اعمل لنفسك صالحا لا تحتفل + بظهور قيل في الأنام وقال
فالخلق لا يرجى اجتماع قلوبهم + لا بد من متن عليك وقال
"তুমি তোমার কল্যাণে সৎকাজ কর, সমাজের যে মজলিসে নিরর্থক বাদানুবাদ হয়, তুমি সেখানে বসবে না। সকলের মনের ঐকমত্য আশা করা যায় না। তাই তোমার প্রশংসাকারীও থাকবে এবং সমালোচকও থাকবে।"
যে ব্যক্তি এই গ্রন্থখানা পাঠ করবে, তাকে আমি আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টিলাভের সুসংবাদ দিচ্ছি। আল্লামা মুনযিরী তাঁর কিতাবের ভূমিকায় বলেছেন, এ কিতাবখানা রচনায় আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করছি। আর আমি ঐ মহান সত্তার কাছে কাতরকণ্ঠে আবেদন করছি, যিনি অসহায়ের ফরিয়াদ গ্রহণ করেন, তিনি যেন এ কিতাবখানির লেখক, পাঠক ও শ্রবণকারী সমস্ত মুসলিম সমাজকে এরদ্বারা উপকৃত করেন।
জেনে রাখুন, আমি হাদীসের শব্দমালা এরূপ বিন্যাস করেছি যেন পাঠক বিশুদ্ধরূপে তা পাঠ করতে পারেন। আল্লাহ্ আমাদের ক্ষমা করুন। কেননা এ কিতাবখানায় সংকলকের প্রশংসা লিখনে আমার কলম অক্ষম। যিনি মুসলমানদের জানানোর উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর হাদীসকে সহজতর করে উপস্থাপন করেছেন, যদ্বারা আপনার বক্ষ উন্মুক্ত হবে, অন্তর উদ্বেলিত হবে, চোখ জুড়াবে, মনের ব্যথা দূর হবে, মন দুশ্চিন্তামুক্ত হবে। গভীর জ্ঞানে আপনি সমৃদ্ধশালী হবেন, প্রকাশ্য বর্ণনা, এর সুঘ্রাণ, তার প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণী, ভাষাগত অলংকার, অনুপম নমুনা, উত্তম নসীহত, নতুন নতুন হিদায়াত দ্বারা আপনাকে শক্তিশালী করবে। আপনি তাঁর কিতাবের অনুচ্ছেদগুলো দ্বারা সামাজিক আচার-আচরণ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ জানতে পারবেন। যা সকল কল্যাণ পুঞ্জীভূত করেছে আর ধর্মের ফল সংগ্রহে এবং আমলকারীদের দীনের ফুল ও ফল অর্জনে অনুপ্রাণিত করবে এবং গুনাহগারদের গুনাহ থেকে ফিরিয়ে রাখবে আর মানব অন্তরে পরকালের ভীতি জাগিয়ে তুলবে। আমি আশা করি, আপনি এ সকল মূল্যবান বস্তু সংগ্রহ করবেন এবং অমূল্য রত্নগুলো আপনি সঞ্চয় করবেন। আপনি আপনার কাজের অবসরে সকাল-সন্ধ্যায় দৈনিক ওযীফায় এক-একটি অনুচ্ছেদ পাঠ করবেন। দেখবেন আপনার সামনে উত্তম উপদেশ উদ্ভাসিত হয়ে পড়বে এবং তার চারিদিকে প্রজ্ঞার জ্যোতি ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহ্ আপনার অন্তরে ঈমানের নূর ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে দেবেন। বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই যে, তাজুদ্দিন সুবকী (র) ইমাম মুনযিরী (র) সম্পর্কে বলেন, তিনি একদিন কায়রোর দারুল হাদীস কামিলিয়াতে হাদীসের পাঠদানে রত ছিলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল তিনি জুমুআর সালাত ব্যতীত দারস থেকে বের হতেন না। তাঁর একজন আলিম ও মুহাদ্দিস সন্তান ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে সওয়াব বৃদ্ধির জন্য সন্তানটিকে তাঁর জীবদ্দশায় উঠিয়ে নেন। তিনি তাঁর ছেলের জানাযা মাদ্রাসার ভেতরে আদায় করেন এবং তাঁর লাশের সাথে মাদ্রাসার দরজা পর্যন্ত যান এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, হে আল্লাহ্! আমার এই সন্তান তোমার নিকট আমানত রাখলাম। এই বলে তিনি তাকে শেষ বিদায় জানান। আল্লাহর মেহেরবানী, তিনি ইবাদত ও ইলম অর্জনের জন্য স্বীয় ঘরে অবস্থান করতেন। এমনকি তাঁর নিজ সন্তানের জানাযায়ও বের হননি।
হে মুসলিমগণ! আমি আপনাদেরকে আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে বলছি, আপনারা যেন আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব কিতাবখানা রাতের সংলাপকারী মুরশিদ হিসেবে গ্রহণ করেন। কারণ গ্রন্থকার আল্লাহ্-ভীরু ছিলেন এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যেই যাবতীয় কাজে মুত্তাকীরূপে জীবনাতিপাত করেন। আল্লাহ্ তা'আলা বলেন, وَاتَّقُواْ اللَّهَ وَيُعَلِّمُكُمُ اللَّهُ "তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তিনি তোমাদের জ্ঞান দান করবেন।" আপনি বিশ্বাস রাখুন, নিশ্চয়ই নিষ্ঠা এমন বস্তু যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালবাসা এবং তাঁদের সন্তুষ্টির (যা মানব সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য) দিকে আকর্ষণ করে। কাজেই তার থেকে ইলম অর্জন করা জরুরী যা মানব অন্তরে প্রবেশ করে জ্ঞান পিপাসা মিটিয়ে দেয় এবং অন্তরের পর্দা উন্মোচিত করে।
তাজউদ্দীন সুবকী (র) তাঁর আল্লাহ্-ভীরুতা এবং নিজ ইলম অনুযায়ী আমলের প্রচণ্ড আগ্রহ সম্পর্কে আমাদেরকে বলেন,
আমি আমার পিতা থেকে শুনেছি, তিনি হাফিয দিময়াতী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, শায়খ মুনযিরী একবার গোসলখানা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং গোসলখানার গরম তাঁকে অস্থির করে ফেলল। তিনি সামনে যেতে অক্ষম হয়ে পড়লেন, এমনকি তিনি রাস্তার একটি দোকানের সামনে লুটিয়ে পড়লেন। অতঃপর দিময়াতী (র) তাকে বললেন, হুযূর! আপনাকে দোকানের মেঝেতে বসাতে চাই। দোকানটি বন্ধ ছিল। তিনি এই দুর্বল অবস্থায় বললেন, দোকানের মালিকের অনুমতি ব্যতীত কিভাবে বসি। তিনি সেখানে বসতে রাজী হলেন না।
হে পাঠক! এই ঘটনাটি সম্পর্কে ভেবে দেখুন। তিনি এমন এক মহান বুযর্গ ছিলেন যে, এমনতর অসুস্থতার মধ্যেও দোকানের মালিকের অনুমতি ব্যতিরেকে তার দোকানের সামনে বসতে রাজী হলেন না। অথচ তখন দোকানটি বন্ধ ছিল। এতে দোকানের ক্রয়-বিক্রয়ের কাজে কোন ব্যাঘাতও ঘটত না। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, মূলত এ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর উত্তম শিক্ষার সুফল। সগীরা গুনাহ যেহেতু কবীরা গুনাহের দিয়ে নিয়ে যায়, তাই আলিম ব্যক্তি সগীরা গুনাহকে তুচ্ছ মনে করতে পারেন না। এজন্যই তাঁরা তা বৈধ করার জন্য ফতওয়া দেন না এবং সহজীকরণের লক্ষ্যে ব্যাখ্যা করেন না।
فلست أرى السعادة جمع مال + ولكن التقي هو السعيد
وتقوى الله خير الزاد ذخراً + وعند الله للأتقى مزيد
"সম্পদ পূঞ্জীভূত করা সৌভাগ্যের লক্ষণ বলে আমি মনে করি না, বরং মুত্তাকী ব্যক্তিই প্রকৃত সৌভাগ্যবান। পরকালের জন্য আল্লাহ্-ভীতি উত্তম সম্বল এবং মুত্তাকীর জন্যই আল্লাহর কাছে রয়েছে বর্ধিত সম্মান।"
বর্ণিত আছে যে, ইমাম গাযালী উমাইয়া যুগের একজন খ্যাতিমান আলিমের প্রশংসায় বর্ণনা করেন যে, একদা উক্ত আলিমের বাড়িতে মুহাম্মদ ইবনে সুলায়মান আসলেন। তিনি তাঁর ঘরে একটি চাটাই, একটি মশক ও একটি ছোট বাক্স ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না। তিনি চাটাইতে বসতেন, মশক থেকে পানি ঢেলে উযু করতেন এবং বাক্সে কিতাব রাখতেন। তিনি উক্ত আলিমকে বললেন, আমি যখনই আপনার নিকট আসি তখনই আপনার প্রতি আমার ভীতি বৃদ্ধি পায়, এর কারণ কি? উত্তরে তিনি যা বললেন তা হাদীসেরই ভাষ্য-"যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি সৃষ্টি জগতের সকলের অন্তরে তার ভীতি সঞ্চার করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ সকল বস্তুর প্রতিই তার মনে ভীতির সঞ্চার করে দেন।" সার কথা এই, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তাকে রক্ষা করেন এবং তার অন্তরকে ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ করেন। কাজেই আল্লাহ্ ব্যতীত কারো দাপট তার অন্তরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না, সে সামান্য বস্তুকেও ভয় পায় এবং তার অন্তর থেকে শান্তি বিদায় নেয়। তিনি তাঁকে চল্লিশ হাজার দিরহাম হাদিয়া স্বরূপ পেশ করলেন। তিনি তা গ্রহণ করলেন না। বরং তিনি বললেন, "এগুলো যাদের হক, তাদেরকেই দিন এবং মযলুমের হক যথাযথভাবে পৌছিয়ে দিন। আল্লাহকে ভয় করুন।"
আমি গাফলতির জন্যে অনুতপ্ত হৃদয়ে লিখছি। কত বেশি অধ্যয়ন করি, কত হাদীস জানি, এতদসত্ত্বেও আল্লাহর ভয় ও ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারি না। রাসুলুল্লাহ্ ﷺ-এর বাণী ভুলে যাই। তিনি বলেছেন: رَأْسُ الْحِكْمَةِ خَشْيَةِ اللهِ "আল্লাহ্ ভীতিই সমস্ত কল্যাণের মূল।" আমার ঈমান দুর্বল, দুনিয়ার ব্যাপারে আমার আকাঙ্ক্ষা প্রবল, আমলশূন্য ইলম ফলবিহীন বৃক্ষ সদৃশ। হে আল্লাহ্! তুমি দয়া কর।
আমার এবং আমার অনুরূপ লোকদের কি সময় আসেনি যে, আমরা এখন থেকেই সতর্ক হয়ে গুনাহ থেকে বিরত থাকি, আল্লাহকে ভয় করি, তাঁর কিতাব অনুযায়ী আমল করি এবং রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরি? আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
"যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা থেকে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম।" (সূরা নূর, ২৪ঃ ৫২)
হে মুসলমানগণ! তাওবার দরজা পুরোপুরিই উন্মুক্ত রয়েছে। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।
আমি কি তোমাদেরকে ও আমাকে এমন ব্যবসার কথা বলব না যা তোমাদেরকে ও আমাকে কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? আর তা হল, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনা এবং দীনের আমল, দীনের সাহায্য ও দীনের আদর্শের দ্বারা সুসজ্জিত হয়ে এবং রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর শরীআতকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাধনা করা।
আত্-তারগীব ওয়াত-তারহীব কিতাবখানা ভালোকাজের উপদেশ ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে এক তরঙ্গসচ্ছল সমুদ্র। আপনারা জানতে পারলেন যে, এই কিতাবের গ্রন্থকার একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা, তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। এই যুগে এই কিতাবখানা যেন আমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ; ইমাম, হাদী ও নূর এবং রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর বাণীসমূহের প্রতি আমাদের পথ প্রদর্শক প্রতিপন্ন হয়।
আল্লাহ্ বলেন:
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
"তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের সাফল্য আশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর ﷺ-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।" (সূরা আহযাব, ৩৩: ২১)
উম্মাতে মুসলিমা যতদিন পর্যন্ত আল্লাহর কুরআন, রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর হাদীসের অনুসরণ, নেককারদের ওসীলা, তাঁদের সাহচর্য অবলম্বন, তাঁদের বাণী অনুসরণ এবং আওলিয়া কিরামের যিয়ারত করবে, ততদিন পর্যন্ত কোন প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। কেননা নবী করীম ﷺ বলেছেন: المرء مع من أحب যাকে ভালবাসে, সে তার সাথে থাকবে।" উল্লিখিত উপদেশ আমাকে আল্লাহর এ বাণী স্মরণ করিয়ে দেয়:
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَىٰ آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِم بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَٰكِن كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُم بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
"যদি সেই সকল জনপদের অধিবাসীবৃন্দ ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি।" (সূরা আরাফ, ৭:১৬)
আমি আশা করি, এরদ্বারা উপকৃত হবো এবং এর আমল কামনা করি। আর আমরা যেন আল্লাহকে ভয় করি। হে আল্লাহ্! আমাদের প্রতি রহম করুন।
বর্তমানে বিশ্ববাসী বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। আল্লাহ্-ভীতি না থাকার কারণেই এটি হচ্ছে। মুসলিম জাতি ধর্মের শিষ্টাচার ভুলে গেছে এবং ভূয়া নাগরিক সভ্যতার পিছনে ছুটছে এবং অনিষ্টকর ও অপরাধমূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। আলিমগণ হিদায়াতের ব্যাপারে ত্রুটি করছেন এবং জাহিল ব্যক্তিরা তার শিক্ষা থেকে বেখবর রয়েছে। সর্বত্র মিথ্যার প্রসার ও জয়-জয়কার। সমাজে মুনাফিকরা নেতৃত্ব দিচ্ছে, সর্বত্র পাপাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, মুসলমানগণ কুরআন-হাদীসের শ্রবণ থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছে, যুব সমাজ ফিরিঙ্গীদের অনুকরণ-অনুসরণে মত্ত-বিভোর। বিদআত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ইন্না লিল্লাহি..... রাজিউন।
হে পাঠক। আপনি আমার সাথে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে পারেন কি? এবং এ গ্রন্থের সংকলক যিনি সর্ববিধ কষ্ট স্বীকার করে এই গ্রন্থখানা সঙ্কলিত করেছেন এবং যিনি মালিকের যমীনে বিনা অনুমতিতে বসে একটু বিশ্রাম গ্রহণে পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানিয়েছেন- তাঁর এ গ্রন্থখানা থেকে উপকৃত হতে চান কি? আল্লাহ্। আল্লাহ্। আল্লাহ্!!!
এই মহান আলিম যিনি তাঁর নিষ্ঠাদ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন এবং আল্লাহ্ তাঁর ইলম দ্বারা জগদ্বাসীকে উপকৃত করেছেন, আল্লাহ্ তাঁকে সত্য যবান ও প্রজ্ঞা দান করেছেন। তিনি মুসলিম উম্মাহর উপকার করেছেন এবং নিজে উপকৃত হয়েছেন। আল্লাহ্ তাঁকে সর্বোত্তম জাযা দান করুন।
ইমাম শামসুদ্দীন আবু আবদুল্লাহ আয-যাহবী (র) এ গ্রন্থের সঙ্কলক সম্পর্কে 'তাবাকাতে হুফফায' গ্রন্থে বলেছেন: কায়রোর যাফেরী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেন। অতঃপর তিনি কামিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শায়খ নির্বাচিত হন। বিশ বছর যাবত উক্ত পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি শিক্ষার বিস্তার ঘটান। হাফিয শরীফ ইযযুদ্দীন (র) বলেন, আমাদের উস্তাদ যাকীউদ্দীন হাদীসশাস্ত্রের মতভেদজনিত বিষয়ে যঈফ ও সহীহ হাদীস নির্ণয়ে, হাদীস বর্ণনার সূত্রে দুর্বলতা, হাদীসের বিধানসংক্রান্ত জ্ঞানে এবং তার দুর্বোধ্য অর্থ নির্ণয়ে ছিলেন অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব। হাদীসের সুনির্দিষ্ট অর্থ নির্ণয়ে, স্বরচিহ্ন দানে এবং শব্দের বিভিন্নতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। রিওয়ায়াত বর্ণনায় তিনি ছিলেন ইমাম, প্রতিষ্ঠিত হুজ্জত এবং অদ্বিতীয় আল্লাহ্-ভীরু ব্যক্তিত্ব। তিনি যা রিওয়ায়াত করতেন, নিজকর্মে তার সাদৃশ্য বজায় রাখতেন। আমি তাঁর নিকট তাঁর সংকলিত হাদীসের একটি বিরাট অংশ অধ্যয়ন করেছি এবং এরদ্বারা আমি যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি।
এই হল সংক্ষিপ্ত বর্ণনা যা আমি আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব পাঠকের জন্য লিপিবদ্ধ করেছি, যাতে পাঠক এর অধ্যয়নে মনোযোগী হন এবং তাঁরা যেন রাসূলুল্লাহ্-এর মহোত্তম চরিত্রে নিজেদের সুসজ্জিত করতে পারেন। আল্লাহ্ তা'আলাই সমস্ত তাওফীকের মালিক। তাঁর পক্ষ থেকেই হিদায়াত এবং সাহায্য ও বিজয়ের সুসংবাদ যা আধুনিক যুগের নেতৃবর্গের জন্য উজ্জ্বল পথ-নির্দেশ।